নিপুদাহ(পর্ব-১)
শৈত্য কবির
নিপু বাতিটা জ্বালিয়ে দে তো মা। আজ মা নিপুকে একটু বেশি ভালবাসছে। কারণ আজ যে নিপু মায়ের সব কথা শুনেছে। বাইরে যায়নি সব কাজ করেছে। বলতে বলতে নিপু বাতি জ্বালায়।নিপু চারটে হারিকেন জ্বালায়।একটা ঠাকুমার ঘরে,একটা বাবার ঘরে আর একটা বারান্দায় রেখে আবশেষটা নিয়ে ঘরে যায়। ঘরে ওর পিসীর ঘাড়ে চার বছরের একটা ছেলে ‘আনন্দ’।নিপুর দুইটা পিসী। আনন্দের মা ছোট। ছোট পিসীর বিয়ের কথা নিপুর মাঝে মাঝেই মনে পড়ে। নিপুর বাবারা দুই ভাই।আর ছোট পিসী যেহেতু সবার ছোট।তাই তার সমাদার ছিল একটু অন্যরকম।এই গাঁয়ে নিপুদের বাড়িটা সবারই দৃষ্টি কাড়ে।কোনো বাহ্যিক চাকচিক্যর জন্য নয়। বরং চাকচিক্য যেটা ছিল তাহলো ভাই-বোনে এমন সদভাব সত্যিই বিরল। ছোট বোনের বিয়ের আয়োজন হলো খুব ঘটার সাথে। সেই বিয়েতে নিপুর খুব মজা হয়েছিল।পিসীর সাথে নিপুও গিয়েছিল।বিয়ের এক বছোর পরেই আনন্দের জন্ম। তার ৬ মাস ঘুরতেই এক নির্মম দুর্ঘটনার স্বীকার হয় ছোট পিসী।সেদিন সকাল থেকে আকাশ পরিষ্কার ছিল। মাঝে মাঝে কেও এক মুঠো করে তুলো আকাশ পানে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিচ্ছিল।
আর তা আকাশের বুকে এসে আনন্দে সাঁতরাচ্ছিল। হঠাত মেঘেদের খেলা বদলে গেল কোথা থেকে এক দুষ্টু লোক ওদের ভ্য় দেখাচ্ছিল আর ওরা আকজায়গায় জড়ো হতে লাগল। সাথে ঝড়ো হাওয়া যেনো ওদের কে উসকে দিতে এলো,সাথে মেঘেরদের মনোরঞ্জনের সুব্যবস্থা।
গুড়ুম-গুড়ুম আওয়াজ ছোট পিসী “যামিনী” বাহিরে এলো শস্য তুলতে।
উঠানে বৃষ্টি কন্যারা কেবলই তাদের নৃত্য শুরু করেছিলো।এক-পা তুলছে,এক পা নামাচ্ছে আর সাথে তাদের টুপটাপ সংগীত ও তাল মিলিয়ে যাচ্ছে।শস্য তুলা প্রায় শেষ বৃষ্টিও খুব জোরে হচ্ছে তা না। শস্য দালা কোমরে নিয়ে যামিনী ঘরে ফিরছে এমন সময় যেন মহা প্রলয়ের সাইরেন বেজে উঠল। আর এই প্রলয়ে কেও যেন যামিনীকে বাজি ধরেছিল।মাটিতে লুটিয়ে পড়ল যামিনী। আর কখন উঠিনি যামিনী,আসেনি আনন্দের মাথার শিওরে।
সেই থেকে আনন্দ মামা বাড়িতে। আনন্দের ছোট মামা অর্থাৎ নিপুর বাবা। আর নিপুর জ্যাঠাই মশাইয়ের দুই ছেলে বড়ো ছেলে শীর্ষেন্দু কলেজে পড়ে কলকাতায় আর ছোট ছেলে হেমেন্দ্র নিপুর থেকে বছর তিনেক ছোট হবে। হেমের সাথে নিপুর শুধু ঝগড়া বাধে তবে তা কখনো দীর্ঘস্থায়ী হয় না। দক্ষিণের ঘরটায় আগে ওরা ৪ জন থাকত। আনন্দ সেই তখন থেকেই নিপুর কাছে থাকে। নিপু ছাড়া তার চলেই না। আজ অনেক দিন পর শীর্ষেন্দু বাড়ি আসল। সেই কলেজ ভর্তি হওয়ার এই প্রথম ও বাড়ি আসল। এদিকে ওর বিয়ের কথা আর্শীবাদ পর্যন্ত গড়াইছে। সে কথা সে কথা জেনে একটু রাগারাগি করল বটে কিন্তু রাগে নয় অতিশয় লজ্জায় এবং উত্তেজনায়, এবার বাড়ি থেকে তাকে বিবাহ না করিয়ে আর পাঠাচ্ছে না। শীর্ষেন্দু এসেছে সেই সকালে এখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলল,এর মাঝে ওর বাবা-কাকাদের পাত্রী বাড়ি হতে একবার ঘুরেও আসা হয়ে গিয়েছে।কাল ও বাড়ি থেকে আসবে। এদিকে বেলা দুপুর হতে নিপু আনন্দ হেমু লাপাত্তা।
নিপুর মা মোহিনীই ওদের ত্তত্ত্বাবধান করে। সে এখন অগ্নিশর্মা।
বাস্তবত মোহিনী খুবই দয়াশীল কিন্তু রেগে গেলে যমদূতকেও হার মানায়।
মোহিনী রেগে গেলে ছোটো বড়ো সবায় ভয়ে থাকে। যদিও কাজটি ভালো না সে জানে।১৯ বছর হতে চলল মোহিনী এ বাড়িতে এসেছে। কখনো অযথা একটা কথা বলেনি,কোনো আবদার রাখেনি।
মোহিনীর বিয়ে হয়েছিল অনেকটা আকষ্কিকভাবে।মোহিনীর বাবা মরলে সেই চিতাই ওর মায়ের দাহআও সম্পন্ন হয়।তখন মোহিনী মাত্র ১৩ বছর। আর তারপর এক বছর মামা বাড়ি থাকে পরে মামারাই কন্যা সম্প্রদান সম্পন্ন করে। মোহিনী যখন এ বাড়িতে আসে তখন নিপুর জ্যাঠাইমার কোলে শীর্ষেন্দু। হঠাত জ্যাঠাইমার একটা বড়োসড়ো অসুখ বেধে বসল। জ্যাঠার কাঠের খড়ির ব্যবসা। তার লাভ আছে লোকসান আছে।তার উপরই একটা অসুস্থ মানুষসহ পুরা পরিবার।মোহিনীর খারাপ লাগত কারণ তখনো নিপুর বাবার রোজগারের কোনো উতস ছিল না। মোহিনী একা হাতে গোটা সংসার সামলাতে লাগল। একটা কাজের মানুষ ছিল জ্যাঠাইমার দেখাশুনা করার জন্য কিন্তু মোহিনীর অনুরোধে তাকেও বিদায় দেওয়া হলো। এ সময় মোহিনী সংসারটাকে আগলে রাখতে লাগল। কিছুদিন পর নিপুর বাবা স্কুলে চাকরি পায়। গণিতের মাস্টার মশাই। তখন থেকে মোহিনীর আবদারে নিপুর বাবা সংসার চালানোর ভার নেয় আর আজ পর্যন্ত তা দায়িত্ব সহকারে পালন করে আসছে। মোহিনীর উন্নত মন-মানসিকতা সত্যিই প্রশ্নংসার দাবি রাখে।তখন থেকে মোহিনীর পরিকল্পনা অনুযায়ী পারিবারিক রীতি হয়েছে বাড়িতে কোন আচার অনুষ্ঠান হলে সেই দায়িত্ব জ্যাঠামশাইয়ের।আর সংসার খরচ নিপুর বাবার।নিপুর বাবা কঠোর পরিশ্রমী,ক্লান্তিকে কখনো তার সাথি হতে দেখিনি,স্কুল আবার বাজারের ভিতরে লাইব্রেরিতে বসা। শীর্ষেন্দুটা এখন বাইরে পড়তে গেছে। ওর খরচ নিপুর বাবাই প্রথম চালাত। তখন নিপুর জ্যাঠাই-মায়ের হঠাত বেড়ে গিয়েছিল।
এখন অবশ্য অনেকটা ভালো।তাই শীর্ষেন্দুর খরচ ওর বাবা-কাকা এখন ভাগ করে নিয়েছে।
নিপুর বাবার বড়ই ইচ্ছা শীর্ষেন্দু একদিন অনেক বড়ো মাস্টার হবে মশায় হয়ে গ্রামে ফিরবে।
তবে শীর্ষেন্দুর বাবার তেমন কোনো ইচ্ছা ছিলো না।ওর বাবা তো ওকে বলেই ছিলো ব্যবসাটা দেখতে।
বাইরে পড়তে গেলে বেশি খরচ,কম উন্নতি। এখানেও মোহিনী সুরাহা করে।এই বাংলার অধিকাংশ সোনার সংসার ভেঙ্গে যায় অর্থনৈতিক পরিকল্পনার অভাবে। যে প্রাণের দোসর ছোটো ভাই ছাড়া বড়ো ভাইয়ের ঘুম আসতনা,বড়ো ভাই ছাড়া ছোটো ভাইয়ের ভরসা করার কেও ছিলনা সেই ভাইয়ে ভাইয়ে কেমন দেয়াল উঠে,বিরোধ লাগে। এই পুরোটাই অর্থনৈতিক অপরিকল্পনার ফল। সংসার খরচ,সম্পদ এই সবের গুণ,ভাগ,যোগ,বিয়োগ কেমন বিষয়ে তোলে স্বর্গীয় সম্পর্কগুলো।আর সাথে থাকে রমণীদের অজানা অসচেতনতা,ঈর্ষা ইত্যাদি। যা অবশেষে বাবা-মাকেও ভাগ করে,গুন করে আরও কত কী।সেদিক থেকে মোহিনী যেনো ভিনগ্রহের রমণী। সত্যিই আশ্চর্য!মোহিনীর বিচক্ষণতা,সচেতনতা,সরলতা পুরোটাই প্রকৃতি ওকে আপন হাতে শিখিয়েছিল। এখন সন্ধা প্রায় হয় হয় অবস্থা।
পশ্চিম আকাশে সূর্য মাথা রেখেছে কিছুক্ষণেই ঘুমিয়ে যাবে। কিন্তু এখন সেই তিন জনের বাড়ি ফেরার নামই নেই।ওর বাবা,জ্যাঠা সেই শীর্ষেন্দুর ভাবী শ্বশুর বাড়ি থেকে ফিরে এসে একবার খোঁজ করেছিল।কিন্তু ব্যস্ততায় পড়ে আর করতে পারিনি।বাজারে চলে গিয়েছে।
সূর্য অস্ত যাচ্ছে আর তার সব তেজ যেন মোহিনীর উপর সপে দিয়েছে।
চলবে,,,,
নিপুদাহ(পর্ব-১)
শিক্ষার্থী ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
0 Comments
Thanks for your comment.