নিপুদাহ পর্ব-৩
শৈত্য কবির
বউদির ঘাড়ে নিপু হাত দিতেই হন্তদন্ত হয়ে
নিপুদের বাড়ীতে ঢুকল অসীম কাকা।শহরে থাকে।নিপুদের দুই বাড়ী পরেই অসীম কাকার বাড়ী আর
সে যে খবর দিল তা যেন কোনো বধু কখনো শুনতে চায় না,কোন মা কখনো বিশ্বাস করতে চায় না, আর কোনো বোন ও মানতে চায় না। শীর্ষেন্দু আর নেই। বউদি নিপুর গায়ে উপর
পড়ে গেল।নিপু বড় অবাক হলো এমন শোক সে কখনো দেখিনি।বউদির জ্ঞান ফিরল বেশকিছুক্ষণ পরে।
এদিকে বন্দোবস্তা অনেক দূর এগিয়েছে। বউদি আবার জ্ঞান হারালো।নিপুর মনে অনেক প্রশ্ন
বউদি কি শুধু দাদার শোকে জ্ঞান হারাচ্ছে নাকি ঐ জলন্ত চিতা,ঐ জলন্ত চিতা যে একটু পরেই গ্রাস করবে বউদিকে সেই বউদির জ্ঞান কাড়ছে।নিপু আর
পারছে না। এই অনাচার তার আর সহ্য হচ্ছেনা। এই মেয়েটার বিয়ে হয়েছে আজ মাত্র আড়াই
মাস যার আলতার দাগ এখনো অজানা।সেই মানুষটার সাথে যার স্পর্শ তার এখনো অজানা। সেই
মানুষটার সাথে যাকে ঠিকমতো চেনাই হলো না। এই জগত বড় অদ্ভুত লাগে নিপুর।মাস কইয়েক
ধরে বাড়িতে চলল শোকের মাতম। বাড়ীর বড়ো ছেলে মরেছে। কতজন কত ভাষায় সান্তনা
দিচ্ছে।ছেলে তো আমাদের স্বর্গে যাবে।আর বউ!আর বউ? বউটার কথা কেউ বলছে না। তার আবার স্বর্গ কী!!!স্বামীর সাথে দাহ হয়েছে এই তার
স্বর্গ। তার জন্য বিশেষ কোনো স্বর্গের ব্যবস্থা থাকতে পারেনা।যেন জঞ্জাল একটা। পুড়েছে
মরেছে আবর্জনা সাফ হয়েছে।দেখতে দেখতে অনেক দিন কেটে গেলো।এদিকে নিপুর যৌবন ও মাথা
চাড়া দিয়ে উঠেছে।সকলেরই চোখে ধরেছে।বিভিন্ন দিক থেকে তার জন্য বেশ কিছু সমন্ধ আসছে,যাচ্ছে।নিপুর মতো সুন্দরী,বুদ্ধিমতী মেয়ে মেলা যে এই সময় সহজ কথা নয় তা আর কারোরই অজানা ছিলোনা। অনেক
সমন্ধ ফিরিয়েছে বাড়ী থেকে।কিন্তু এবার এমন সমন্ধ এসেছে যা ফিরানোর সম্ভব নয়। তাছাড়া
ফিরাবার ইচ্ছা ও নেই কারোর। নিপুর বাবা মনে মনে এমন সমন্ধ খুজছিলেন। তারাও ওনেক
খুজে খুজে এসেছে।ছেলের বাবা গত হয়েছে প্রায় এক বছর হলো।মা ভালই ছিলেন।হঠাত চোখে
ছানি পড়ে সে এখন কিছুই দেখতে পায় না। ছেলে ডাক্তারি পাশ। চাকরিও পেয়েছিল।কিন্তু
মায়ের অবস্থা হওয়াই তা ছেড়ে চলে এসেছে। এখন বাপ ঠাকুরদার বিষয় আশয় তদারকি করছে আর
এখানেই একটি হাসপাতাল খোলার বন্দোবস্তা করছে। নিপুকেও রাজি হতে হলো। এই বাড়ীর
একমাত্র মেয়ে তার বিয়ে নিশ্চয় যেন তেন ভাবে হবে না। বিয়ের দিন উপস্থিত হতে হলো। নিপুর
জ্যাঠা বলল শীর্ষেন্দুটা যাওয়ার পরে যেন এই বাড়ীটার প্রাণটা ও গেছে,আমি চাই আমার নিপু মায়ের বিয়ের মাধ্যমে তা আবার ফিরে আসুক। তিনদিন আগে থেকে
ঢাকি এনে রাখা হলো।খাওয়া দাওয়ার বিশাল আয়োজন করা হলো। বিবাহ সম্পন্ন হলো।নিপু
শশুরালয়ে প্রবেশ করল। কিন্তু তাকে আর নতুন বউ হয়ে থাকা হলো
না।পরদিন থেকেই নিপু কাজে লেগে গেল। দাস দাসী ছিলো কিছু তবে নিপুর মতে ওরা থাকলেই
বেশি কাজ। এই স্বভাবটা অবশ্য পেয়েছে মোহিনীর থেকেই। এখন বাড়ীতে মাত্র অরা তিনজন। নিপুর
অঢেল সময় পড়েই থাকে। মাঝে মাঝে ওর বিরক্তও ধরে যায়।বইপত্র যা ছিলো তা যে কতবার
পড়েছে ও তার কোনো হিসাব নেই। নিপু মনে মনে ভেবেছে ডাক্তারকে কিছু বই এনে দিতে
বলবে। কিছুদিন নিপু খুবই লজ্জা পেত।আর ডাক্তার যখন নিপুর ইংরেজি নাম রাখলো।
বলল তুমি আমার জড়ংব(রোজ)। আজ থেকেই আমি
তোমাকে জড়ংব বলেই ডাকব।তখন তো নিপু বড়ো দিশেহারা হয়ে পড়েছিল।প্রথম নামটা ভালো না
লাগলেও জানার পরে বেশ লাগত নিপুর। ডাক্তার নিপুকে বেশ কিছু বই এনে দিয়েছিল। এক দিন
রাতে নিপু কেবলই বইগুলো
নিয়ে বসে নাড়াচাড়া করছে।ডাক্তার চলে এসেছে দেখে নিপু উঠে এগিয়ে গেল। হাত-মুখ ধোয়ার
জল এগিয়ে দিল। ডাক্তার খাওয়ার ঘরে চলে গেল।নিপু সব গুছিয়েই রেখেছিল। শুধু একটা হাত
পাখা নিয়ে এগিয়ে গেল।গ্রীষ্মের তীব্র গরমে জনজীবন একদম অতিষ্ট হয়ে পড়েছে।গরমে পশু-পাখি থেকে শুরু করে মানুষ পর্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়ছে।ডাক্তার
খাওয়া শেষ করে মায়ের ঘরে গেল। নিপু সব গুছিয়ে রেখে নিজের ঘরে চলে গেল।কিছুক্ষন পর
ডাক্তার ঘরে এসে নিপু কে বাতি নিভিয়ে দিতে বলে শুয়ে পড়ল। নিপুর বেশ অবাক লাগল কারণ
প্রতিদিন ডাক্তার বেশ রাত করে ঘুমায়।নিপুর সাথে বসে বই পড়ে।নিপু আর ভাবলো না। আজ
অনেক খরা পড়েছে আর ডাক্তারেরও আজ বাহিরে অনেক কাজ ছিল।এইবার নিপু ও ঘুমানোর
বন্দোবস্থা সম্পূর্ণ করে বাতি নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।নিপুর ঘুম আবার গভীর।একবার ঘুমিয়ে
পড়লে আর কিছু টের পায় না। তবে ও খুব ভোরেই উঠে পড়ে।আজ সকালে ও যথারীতি ভোরে উঠে ওর
দৈনন্দিন কাজের সমাধায় লেগে গেল। জলখাবার তৈরি করে আগে শাশুড়ীর ঘরে দিয়ে আসল। তারপর
নিজের ঘরে দুজনেরটাই একসাথে নিয়ে গেল। ডাক্তারকে কয়েকবার ডাকও দিল নিপু,কিন্তু কোনো সাড়া শব্দ নেই।ডাক্তারের দেহ ঘেষে বসতেই নিপুর অনুভবে যে শরীর
বাধল তা বড় অচেনা।ডাক্তারের নিথর দেহ বড় ঠান্ডা হয়ে গেছে আর তা ক্রমশ ফ্যাকাশে
বর্ণ ধারণ করেছে।নিপু যেন সব বুঝেও কিছু বুঝতে পারলো না। নিপু চিৎকার করল কিন্ত
কোনো আওয়াজ হলো না। নিপু কাদলো কিন্তু চোখে জল আসলো না।নিপু ভাবলো কিন্তু কোনো
ভাবনা ওর আসল না। নিপুর সামনে চিতা দাউ দাউ করে জ্বলছে কিন্তু নিপু পুড়ল না।নিপু
অনেক প্রশ্ন করল তারও কোনো উত্তর মিলল না।নিপুর শুধু মনে পড়ল ডাক্তারের সেই কথা
গুলো।ডাক্তার বলেছিলো কীভাবে তারা মরা মানুষ রাখার বন্দোবস্তা করে। নিপু নিশব্দে
সেসব জোগাড় করতে লাগলো।নিমপাতা পাড়তে যেয়ে হাত কাটলো কিন্তু এক ফোটাও রক্ত বেরোল
না। অন্ধ শাশুড়ীকে নিশ্চিত করল এই বলে যে ছেলে কিছুদিনের জন্য বাইরে গেছে।কিন্তু
এই চেষ্টা যে বড় ব্যর্থ।বড় অসহায়।তারপরও দুইটা দিন নিপু বেশি বেচেছে।এই দুইদিন ছিল
যেন নিপুণায়নের নিজের জীবন বাকিটা তো যেন কোনো পরগাছার ছিলো।অন্ধ শাশুড়ি
দুর্গন্ধের কিনারা না করতে পারলেও প্রতিবেশীরা ঠিকই পারলো।
0 Comments
Thanks for your comment.